এআইতে ঝুঁকি থাকলেও তা নিয়ন্ত্রন সম্ভব – বিল গেটস

টেকশহর কনটেন্ট কাউন্সিলর: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলোকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হতে পারে। বুদ্ধিমান মেশিনের কাছে কাজ হারিয়ে ফেলা ব্যক্তিদের কি হবে? এআই কি নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলবে? ভবিষ্যত এআই যদি মানুষ প্রয়োজন নেই বলে সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে কি হবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি একসময় মানুষের থেকেই পরিত্রান পেতে চাইবে? এগুলো সবই সঠিক প্রশ্ন। এআইকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া উদ্বেগগুলোকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। তবে একটি বিষয় ভেবে রাখা ভালো, যে আমরা এ ধরনের সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে পারি। কারণ গুরুত্বপূর্ণ কোন উদ্ভাবন নতুন নতুন হুমকি সৃষ্টি করেছে এবং তা নিয়ন্ত্রন করতে হবে এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আমরা এমন কাজ আগেও করেছি।

যখন গাড়ি আবিষ্কার হলো অথবা ব্যক্তিগত কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট আসলো তখনও কিন্তু একটি রূপান্তরের সময় এসেছিল। সেসময় এসব নতুন প্রযুক্তি সহজে মেনে নেয়া হয় নি; সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং একসময় ঠিকও হয়ে গিয়েছে। স্বয়ংক্রিয় গাড়ি রাস্তায় নামার পরপরই প্রথম গাড়িটিই দূর্ঘটনার কবলে পড়ে। কিন্তু তাই বলে কিন্তু আমরা গাড়ি নিষিদ্ধ করি নি। বরং আমরা গতি সীমাবদ্ধ করেছি, নিরাপত্তা মানদন্ড গ্রহন করেছি, লাইসেন্সের শর্ত দিয়েছি, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি না চালানোর আইন করা হয়েছে এবং সড়ক পথের জন্য আরো কিছু নীতিমালা করা হয়েছে।

বর্তমানে এআইয়ের এই সময়ে এসে আমরা আরেকটি বড়ধরনের পরিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। গতি নিয়ন্ত্রন ও সীট বেল্ট বাঁধার মতো পদক্ষেপ নেয়ার আগে যে ধরনের অনিশ্চয়তা ছিলো আমরা তেমনই সময় কাটাচ্ছি এখন। এআই এতো দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে যে সত্যিকার অর্থে আমরা পরিস্কারভাবে বুঝতে পারছি না এরপরে কি ঘটতে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রযুক্তিটি যেভাবে কাজ করছে, অসৎ উদ্দেশ্যে এটি যেভাবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং এআই সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে আমাদেরকে পরিবর্তিত করতে পারে তা নিয়ে আমরা নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হচ্ছি।

Techshohor Youtube

এমন একটি পরিস্থিতিতে অনিশ্চিত অনুভব করাটা খুবই স্বাভাবিক। তবে আমরা ইতিহাস থেকে দেখেছি নতুন নতুন প্রযুক্তির কারণে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা সম্ভব। এআই কিভাবে আমাদের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে তা নিয়ে আমি আগেও লিখেছি। প্রযুক্তিটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে সেসব সমস্যার সমাধানে সাহায্য করবে যা অসম্ভব বলে মনে করা হতো। গেটস ফাউন্ডেশন বিষয়টি অগগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেখছে এবং এআই কিভাবে অসমতা দূর করবে সে বিষয়ে নিজের ভাবনা প্রকাশ করেছেন আমাদের সিইও মার্ক সুজম্যান। ভবিষ্যতেও আমি এআইর সুবিধা নিয়ে আরো অনেক কথা বলবো। কিন্তু আমার এ লেখায় এআই নিয়ে যেসব উদ্বেগের কথা শুনেছি, পড়েছি সেগুলো নিয়েই কথা বলবো এবং এসব বিষয় নিয়ে আমার চিন্তা ভাবনার ব্যাখ্যা দিবো।

একটি বিষয় পরিস্কার এআইয়ের ঝুঁকি নিয়ে অনেক লেখা হলেও এসবের সার্বিক সমাধানের বিষয়ে কেউ কিন্তু কথা বলেন নি। তবে একটি বিষয় আমার কাছে পরিস্কার এআইয়ের ভবিষ্যত নিয়ে অনেকেই যতটা ঝুঁকি দেখছেন আসলে বিষয়টি তেমন হবে না আবার এটি নিয়ে এতোটা উচ্ছাস প্রকাশ করারও কিছু নেই। ঝুঁকির বিষয়টি সত্যি তবে এগুলো নিয়ন্ত্রন করা নিয়েও আমি আশাবাদী।

– এআইয়ের কারণে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে প্রযুক্তি নিয়ে সৃষ্ট এমন অনেক সমস্যাই অতীতে দেখা গিয়েছে। যেমন- এআই শিক্ষার ওপর এর একটি বড় প্রভাব ফেলবে। কয়েক দশক আগে ক্যালকুলেটর আবির্ভাবের সময় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিলো। অতি সম্প্রতি ক্লাসরুমে কম্পিউটার ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অতীতের থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি।

– এআই থেকে সৃষ্ট অনেক সমস্যাই এআইয়ের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। আমাদেরকে পুরনো আইন মানিয়ে নিতে হবে এবং নতুন আইন গ্রহন করতে হবে।

এই পোস্টে আমি বর্তমানে কোন ঝুঁকিগুলো রয়েছে অথবা ভবিষ্যতে কোন ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করবো। তবে এআই প্রযুক্তি তৈরি করলে কি হবে তা আজ আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমরা এক দশক অথবা এক শতাব্দী পরেও একটি পয়েন্টে পৌঁছুলেও সমাজকে কিছু গভীর প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে। যেমন-একটি সুপারএআই যদি নিজস্ব লক্ষ্য নির্ধারন করে তাহলে কি হবে? মানবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে কি হবে? আমারদের কি আদৌ সুপার এআই নির্মাণ করা উচিত।

এআইয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট ডিপফেইক ও মিথ্যা তথ্য নির্বাচন এবং গণতন্ত্রকে বিঘ্নিত করবে কি?

মিথ্যা ও অসত্য তথ্য ছড়িয়ে দিতে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে এটি নতুন কোন আইডিয়া নয়। শতকের পর শতক ধরে বই এবং লিফলেটের ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে আসছে। প্রসেসর, লেজার প্রিন্টার, ইমেইল এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আবির্ভাবের সাথে সাথে কাজটি আরো সহজ হয়ে উঠেছে। এআইয়ের সুবাদে ভুয়া পরিমান বাড়ছে। এরফলে যে কেউ ভার্চুয়ালি ডিপফেইক নামে ভুয়া অডিও এবং ভিডিও তৈরি করতে পারে। আপনি যদি আপনার বাচ্চার কন্ঠের মতো ভয়েস ম্যাসেজ পান যেখানে বলা হচ্ছে, ‘ আমাকে কিডন্যাপড করা হয়েছে, ১০ মিনিটের মধ্যে এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক হাজার ডলার পাঠান। কোনভাবেই পুলিশ ডাকা যাবে না। ’ ইমেইলের তুলনায় এ ধরনের ভয়েস ম্যাসেজ আমাদেরকে মানসিকভাবে অনেক বেশি আলোড়িত করবে। বৃহৎ পরিসরে এইআইয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট ডিপফেইকগুলো নির্বাচনকে ভন্ডুল করতে ব্যবহৃত হতে পারে। এছাড়াও বৈধভাবে বিজয়ীর বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ করতে কোন সংবেদনশীল প্রযুক্তির প্রয়োজন হয় না। এআই খুব সহজে কাজটি করতে পারে।

জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের নিয়েও ইতোমধ্যে অনেক ভুয়া ভিডিও তৈরি হয়েছে। ধরা যাক একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের দিন সকালে প্রকাশ হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেল একজন প্রার্থী ব্যাংক ডাকাতি করছে। ভিডিওটি মুহুর্তে ভাইরাল হয়ে গেল। ভিডিওটি যে ভুয়া তা প্রমান করতে অনেক নিউজ আউটলেট প্রকাশ করতে হয়েছে , ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে প্রচারনা চালাতে হয়েছে। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন রয়ে যায় কতো মানুষ ভিডিওটি দেখেছেন এবং একেবারে শেষ সময়ে এসে কতোজন নিজেদের ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন? তবে এটি নির্বাচনকে প্রভাবিত করে বিশেষ করে বড় নির্বাচনকে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটিতে ওপেনএআইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যান যখন স্বাক্ষ্য দিচিছলেন তখন উভয় দলের সিনেটররা নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ওপর এআইয়ের প্রভাব শূণ্য বলে মতামত দেন। কিন্তু এরপরেও এ বিষয়টি সবার এজেন্ডাতেই ঘুরেফিরে আসবে। মিথ্যা তথ্য ও ডিপফেইকের সমস্যাগুলো আমরা অবশ্যই সমাধান করতে পারবো না।

তবে দুটি বিষয় এক্ষেত্রে আমাকে ইতিবাচক করে তুলেছে। একটি বিষয় হচ্ছে , যা কিছু দেখা যায় সবই সত্যি বলে গ্রহন না করার সক্ষমতা রয়েছে মানুষের। বহুবছর ধরেই মানুষ ইমেইল স্ক্যামের স্বীকার হয়ে আসছেন। এরআগে কেউ একজন নিজেকে নাইজেরিয়ায় রাজপুত্র উল্লেখ করে ভুয়া মেইলের মাধ্যমে জানায় তার সাথে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর শেয়ার করলে মোটা অংকের অর্থ দেয়া হবে। তবে দেখা যায় বেশিরভাগই এ ধরনের ফাঁদে পা দেয়ার আগে দুইবার মেইলটি চেক করে। স্ক্যামগুলো যত সংবেদনশীল হয় ততই তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারে। ডিপফেইকের ক্ষেত্রেও একই ধরনের শক্তি তৈরি করতে হবে।

আরেকটি আশার কথা হচ্ছে এআই যেমন ডিপফেইক তৈরি করতে পারে তেমনি শনাক্তও করতে পারে। যেমন- ইন্টেল একটি ডিপফেইক ডিটেক্টর তৈরি করেছে এবং সরকারি সংস্থা ডিএআরপিএ কারসাজি বা ম্যানুপুলেট করা ভিডিও এবং অডিও শনাক্ত করতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে। মূলত এটি একটি চক্রাবার প্রক্রিয়া হবে। কেউ একজন ভুয়া টেক্সট যাচাই করার উপায় খোঁজে পায়, কেউ আবিষ্কার করে কিভাবে তা প্রতিরোধ করা যায় এমন আরো অনেক কিছু। হতে পারে এসব উপায় থেকে পুরোপুরি সফলতা আসবে না তবে একেবারে আশাহত হওয়ার মতোও ব্যাপার হবে না।

সাধারন মানুষ ও সরকারের উপর আক্রমন সহজ করেছে এআই

বর্তমানে হ্যাকারা সফটওয়্যারের যেকোন ত্রুটি খুঁজতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা একটি উপায় না পেয়ে যায় ততক্ষণ তারা বিভিন্ন রাইটিং কোড এবং সম্ভাব্য দূর্বলতাগুলো দেখতে থাকে। এজন্য অনেক ধৈর্য্য ও সময় নিয়ে নানা দিক দেখতে হয়। হ্যাকারদের প্রতিরোধ করতে চায় এমন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদেরকে একইভাবে কাজ করতে হবে। আপনার ফোন বা ল্যাপটপে ইনস্টল করা যেকোন সফটওয়্যারটি ভালো এবং মন্দ উদ্দেশ্যে থাকা উভয় ধরনের ব্যক্তিরাই ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে অনুসন্ধান করতে থাকে। এআই মডেলগুলো হ্যাকারদের জন্য আরো কার্যকরী কোড লিখতে সাহায্য করে এই প্রক্রিয়াটিকে আরো ত্বরান্বিত করেছে।

এআই যেকোন ব্যক্তির বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য যেমন সে কোথায় কাজ করে, তার বন্ধু কে এসব ব্যবহার করে আক্রমনকে আরো ত্বরান্বিত করে। তবে আনন্দের খবর হচ্ছে এআই মন্দের পাশাপাশি ভালোর উদ্দেশ্যও ব্যবহার করা যায়। সরকার এবং অপরাধীরা কোন সুযোগ নেয়ার আগেই বেসরকারি খাতের নিরাপত্তা দলগুলোকে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ত্রুটিগুলোকে খুজে বের করে তা ঠিক করতে হবে। আমি আশা করবো সফটওয়্যার সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রি এ বিষয়ে যে কাজ শুরু করেছে তা আরো সম্প্রসারিত করবে।

আর এ কারনেই আমাদেরকে এআইয়ের নতুন নতুন আবিষ্কার থেকে মানুষদেরকে সাময়িকভাবে হলেও দূরে রাখা উচিত নয়। কারণ সাইবার অপরাধীরা নতুন টুল আবিষ্কার করেই যাবে। পারমানবিক এবং জৈব হামলার নকশা করতে এআই ব্যবহারও ঠেকানো যাবে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো একটি ঝুঁকি রয়েছে। অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে সাইবার হামলা করতে এআইয়ের জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ জন্য সাইবার হামলা মোকাবিলা করতে প্রত্যেক সরকারকে আরো শক্তিশালী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। এ জন্য ইন্টারন্যাশনাল অটোমেটিক এনার্জী এজেন্সির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রয়োজন।

এআই মানুষের কাজ কেড়ে নিবে

এআইয়ের সুবাদে আরো দক্ষভাবে কাজ করা সম্ভব হবে, তাই আগামি কয়েকবছরের মধ্যে এআইয়ের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে কাজের ওপর। একটি কারখানায় কাজ হোক বা অফিসে বিক্রয় কর্মীর কাজ করা এবং অ্যাকাউন্ট পরিচালনা সবক্ষেত্রেই এআইয়ের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়াও এআই ইমেইল লেখা এবং ইনবক্স ম্যানেজ করার মতো সহায়তা করে থাকে।

ফেব্রুয়ারিতে লেখা আমর পোস্টে বলেছি যখন উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে তখন কিন্তু এআই সমাজের জন্য ভালো। এটি কাজ এবং বাড়িতে অন্যান্য কাজের জন্য আরো সময় দেয়। শিক্ষকতা, রোগীর সেবাযত্ম, বয়স্ক মানুষকে সহায়তা করার মতো কাজের জন্য লোকের চাহিদা সবসময়ই থাকবে। তবে এটি সত্যি যে এআই পরিচালিত কর্মস্থলের জন্য কিছু কর্মীকে সহায়তা এবং পুনরায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর এ কাজের দায়িত্ব সরকার এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের।

কর্মীরা যাতে পেছনে পড়ে না থাকে এজন্য তাদের এ কাজ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ম্যানুফ্যাকচারিং কাজ পতনের সময় সাধারন মানুষের জীবনমানে যে পতন হয়েছিল সে ধরনের পরিস্থিতি এড়াতেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে নতুন প্রযুক্তির কারণে শ্রমবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। আর আমি মনে করি না যে এআইয়ের প্রভাব শিল্প বিল্পবের মতো এতো বিস্তৃত হবে। তবে বলা যায় পিসি আবির্ভুত হওয়ার সময় যেমন একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছিল বিষয়টি তেমন হতে পারে। ওয়ার্ড প্রসেসিং অ্যাপ্লিকেশনের কারণে অফিসের কাজগুলো দূর হয়ে যায় নি কিন্তু কাজের ধরন চিরতরে বদলে গিয়েছে। নিয়োগদাতা ও কর্মীদেরকে এ পরিবর্তন গ্রহন করা প্রয়োজন ছিল এবং তারা তা গ্রহন করেছে। এআইয়ের কারণে সৃষ্ট পরিবর্তনটি বেশ আড়ম্বরপূর্ণ হবে। তবে মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রতিবন্ধকতা কমানোর মতো ভাবনা ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

এআই উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের পক্ষপাত বয়ে বেড়ায়

এআই যখন কোন অসত্য বিষয়কে আত্ম বিশ্বাসের সাথে উল্লেখ করে তখন তাকে হ্যালুসিনেশন টার্মে অভিহিত করা হয়। সাধারত এআই যখন আপনার অনুরোধটি ভালোভাবে বুঝতে পারবে না তখনই একধরনের হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এআইকে চাঁদে ছুটি কাটানো নিয়ে একটি ছোট স্টোরি লেখার নির্দেশ দিলে এটি খুব ভালো একটি কল্পনাপ্রসূত উত্তর দেয়। কিন্তু একে তানজানিয়ায় ভ্রমন সম্পর্কে কিছু বলতে বললে এটি আপনাকে এমন একটি হোটেলের কথা জানাবে যার কোন অস্তিত্বই নেই।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আরো একটি ঝুঁকি হচ্ছে এটি নির্দিষ্ট লিঙ্গ পরিচয়, জাতি এবং জাতিসত্তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতকে প্রতিফলিত করে, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে তা আরো বাড়িয়ে দেয়। হ্যালুসিনেশন এবং পক্ষপাত কেন হয় তা বুঝতে হলে বেশিরভাগ এআই মডেল কিভাবে কাজ তা বোঝার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো কোডের খুবই সংবেদনশীল সংস্করণ যা আপনার ইমেইল অ্যাপকে আপনি পরবর্তীতে কি নির্দেশ দিবেন তা এআই পূর্বাভাস দিতে পারে। অ্যালান টিউরিং ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যানডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজির মতো সংগঠনগুলো এই পক্ষপাতমূলক সমস্যা নিয়ে কাজ করছে।

সবশেষে বলা যায় এআই ব্যবহারকারী সবাইকে এই পক্ষপাতমূলক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং একজন জানাশোনা ব্যবহারকারী হয়ে উঠতে হবে। আপনি এআইকে যে রচনা লিখতে দিবেন তা অনেক ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। এক্ষেত্রে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে এগুলো চেক করতে হবে।

এআই এর কারণে শিক্ষার্থীরা লেখা শিখবে না

এআই শিক্ষার্থীদের শেখার মান দূর্বল করে দিবে বলে অনেক শিক্ষকই উদ্বেগে রয়েছেন। এমন একটি সময় আসবে যখন ইন্টারনেট রয়েছে এমন যে কেউ একটি রচনা লেখার জন্য এআই ব্যবহার করবে। এক্ষেত্রে এআইর সহায়তা নিয়ে নিজেদের কাজ করা থেকে শিক্ষার্থীদের কিভাবে বিরত রাখা যাবে। তবে ইতোমধ্যে কিছু কিছু এআই টুল রয়েছে যা বলতে পারে লেখাগুলো কোন ব্যক্তি নাকি কম্পিউটার লিখেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা বাড়ির কাজ নিজেরাই করেছে কিনা তা শিক্ষকরা বুঝতে পারবেন।

তবে কিছু শিক্ষক রয়েছেন যারা এআই ব্যবহার করে বাড়ির কাজ করা থেকে শিক্ষার্থীদের বিরত করবে না বরং আরো উৎসাহী করবেন। যেমন- জানুয়ারিতে প্রবীন ইংরেজি শিক্ষক চেরি শিল্ডস এডুকেশন উইকে লেখা এক আর্টিকেলে লিখেন তিনি কিভাবে ক্লাসরুমে এআই ব্যবহার করেন। প্রযুক্তিটি রচনা লেখা শুরু করা থেকে কাজের ফিডব্যাকও দেয়। তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষকদেরকে এআই প্রযুক্তি গ্রহন করতে হবে কারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এটি আছে। একসময় আমরা যেমন শিক্ষার্থীদেরকে গুগল সার্চ শেখাতাম বিষয়টি তেমনই। চ্যাটজিপিটিবট রচনা লেখার ক্ষেত্রে কিভাবে সহায়ক হতে পারে তা শিক্ষকদেরকে শেখাতে হবে। ’ সব শিক্ষকের হয়তো এআই সম্পর্কে জানা এবং তা ব্যবহারের সময় নেই; তবে চেরির মতো শিক্ষকরা এরপক্ষেই থাকবেন।

এআই নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে সত্তর এবং আশির দশকে ইলেক্ট্রনিক ক্যালকুলেটর আবির্ভাবের সময়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। সেসময় গণিতের অনেক শিক্ষকই আশঙ্কা করেছিলেন এই ক্যালকুলেটর আসার কারণ শিক্ষার্থীরা মৌলিক পাটিগণিতের বিষয়ে কিছুই শিখতে পারবে না। কিন্তু বাকিরা এই নতুন প্রযুক্তিটিকে গ্রহন করেছিলন এবং তারা পাটিগণিতের পেছনে দক্ষতার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এআই লেখা এবং জটিল বিষয়ে চিন্তা করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে এআই প্রযুক্তির এই শুরুর দিকে বিভ্রান্তি ও পক্ষপাতের সমস্যাগুলো রয়েছে। এক্ষেত্রে এআই এর মাধ্যমে তৈরি করা আর্টিকেলগুলো দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে ফ্যাক্ট চেক করিয়ে নিতে পারেন।

খান একাডেমি এবং ওইআর প্রজেক্টের মতো এডুকেশন ননপ্রফিট সংগঠনগুলো শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদেরকে ফ্রি অনলাইন টুলস দিচ্ছে। মিথ্যা থেকে সত্য কিভাবে আলাদা করা যায় তা জানার চেয়ে কিছু দক্ষতা অর্জন করা আরো গুরুত্বপূর্ণ।

এরপর কি?

এআই ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রন করা যাবে এতে আশাবাদী না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দ্রুত সামনে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের সরকারকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে নিজেদের দক্ষ করে তুলতে হবে যাতে করে এই নতুন প্রযুক্তিটি নিয়ে তারা তথ্যবহুল আইন ও নীতিমালা তৈরি করতে পারে। তাদেরকে মিথ্যা তথ্য, ডিপফেইক, নিরাপত্তা হুমকি, শ্রমবাজারের পরিবর্তন এবং শিক্ষার ওপর প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে ডিপফেইক ব্যবহার বৈধ তা আইনে পরিস্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। এছাড়া ডিপফেইককে এমনভাবে লেবেল করতে হবে যেন সবাই বোঝতে পারে তারা এখন যা দেখছে বা শুনছে তা সত্য নয়।

রাজনৈতিক নেতাদেরকে তাদের ভোটারের সাথে তথ্যবহুল এবং সুচিন্তিতভাবে কথা বলার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। বেসরকারি খাতের ক্ষেত্রে এআই কোম্পানিগুলোকে তাদের ক্ষেত্রে আরো নিরাপদ ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন হতে হবে। এর মধ্যে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা, তাদের এআই মডেলে মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত হবে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও যতটা সম্ভব বেশি মানুষের কাছে এর সুবিধা ছড়িয়ে দিতে হবে এবং অপরাধী ও সন্ত্রাসীকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে হবে। সবশেষে আমি সবাইকে যতটা সম্ভব এআইয়ের অগ্রগতিকে অনুসরনের উৎসাহ দিচ্ছি।

এটি আমাদের জীবদ্দশায় সবচেয়ে রূপান্তরযোগ্য উদ্ভাবন। এটি নিয়ে খুব ভালো আলোচনা তখনই হবে যখন কিনা এই প্রযুক্তি, এর সুবিধা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে সবাই জানবে। প্রযুক্তিটি থেকে অনেক সুবিধা আসবে। আর আমরা অতীতেও অনেক ঝুঁকি মোকাবিলা করেছি তাই এআইয়ের ঝুঁকিও নিয়ন্ত্রন করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।

গেটসনোট/আরএপি



from টেক শহর https://ift.tt/kGrBNLo
Previous Post Next Post