টেকশহর কনটেন্ট কাউন্সিলর: আর্টিফেসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে এখন পুরো বিশ্বে প্রতিযোগিতা চলছে। অন্যান্য বিষয়ের মতো বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। যদিও গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে চীনকে পিছিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র রফতানি নিষেধাজ্ঞাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপ এআই প্রযুক্তি উৎকর্ষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। জাপানের হিরোশিমা শহরে অনুষ্ঠিত জি৭ সম্মেলনেও এ শঙ্কার ছায়া দেখা গিয়েছে।
এআই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। চীনে সেমিকন্ডাক্টর রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ক্ষেত্রে বেইজিং পিছিয়ে পড়তে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরেও এআই নিয়ে প্রতিযোগিতার চীন দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
ত্রিভিয়াম চায়নার প্রযুক্তি নীতিবিভাগের প্রধান কেন্দ্র শেফার বলেছেন, চীনের ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট কোম্পানির তুলনায় উন্নত। যদিও এটি নির্ভর করছেন আপনি কিভাবে উন্নয়ন পরিমাপ করছেন তার ওপর। অবশ্য উচ্চমানের পণ্য ও সরঞ্জাম তৈরির ক্ষেত্রে চীন আন্তর্জাতিক নেতাদের থেকে ১০ থেকে ১৫ বছর পিছিয়ে রয়েছে।
বিষয় যখন সিলিকন ভ্যালি !
সিলিকন ভ্যালি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সুবিধার নাম। এটি বিশ্বে সেরা উদ্যোক্তাদের প্রাণকেন্দ্র। গুগল, অ্যাপল এবং ইন্টেলের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের জন্মভূমি এই সিলিকন ভ্যালি। হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সেন্টার ফর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স রিসার্চের পরিচালক প্যাসকল ফাং বলেছেন, দেশটির উদ্ভাবকরা অনবদ্য গবেষণা সংস্কৃতি থেকে উপকৃত হয়েছেন। প্রায় সময়ই গবেষকরা কোন পণ্যের কথা মাথায় না রেখে শুধুমাত্র প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য বছরের পর বছর ব্যয় করেছেন। যেমন ওপেন এআই যখন ট্রান্সফরমার মেশিন লার্নিং মডেল নিয়ে কাজ করেছে তখন বেশ কয়েক বছর একটি অলাভজনক কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। অথচ চীনের বেশিরভাগ কোম্পানিতে এই পরিবেশ কখনোই থাকতো না। জনপ্রিয়তার দেখা পাওয়া মাত্রই তারা ডিপ লার্নিং সিস্টেম অথবা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল নির্মাণ শুরু করে দিতো। এটি চায়নিজ এআইয়ের জন্য একটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ। গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরাও বেশ সাহায্য করে থাকেন। ২০১৯ সালে মাইক্রোসফট জানিয়েছিল তারা ওপেনএআইতে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। মাইক্রোসফটের প্রধান সত্য নাদেলা বলেছেন, ‘ এআই আমাদের সবচেয়ে যুগান্তকারী প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের সবচেয়ে কঠিনতম চ্যালেঞ্জের অনেকগুলোই এআইর মাধ্যমে সমাধানের সম্ভাবনা রয়েছে।’
চীনের অবস্থা
বিশাল ভোক্তা গোষ্ঠীই চীনের প্রধানতম সুবিধার জায়গা। মোট ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশ। দেশটির একটি সমৃদ্ধ ইন্টারনেট খাত রয়েছে বলে জানিয়েছেন রেস ক্যাপিটালের সহযোগি এডিথ ইউয়াং । দেশটির প্রায় সব নাগরিকই সুপারঅ্যাপ উইচ্যাট ব্যবহার করেন। টেক্সট ম্যাসেজ পাঠানো থেকে শুরু করে চিকিৎসকের অ্যাপয়নমেন্ট দেয়া এবং কর দেয়ার মতো কাজও এই একটি অ্যাপের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়। ফলে এখানে পণ্যের উন্নয়নের জন্য প্রচুর তথ্য থাকে। এ প্রসঙ্গে ইয়াং বলেছেন, ‘ এআই মডেলটি ততটাই ভালো হতে পারে যতটা তথ্য শেখার জন্য পাওয়া যায়। ভালো হোক বা মন্দ ব্যবহারকারীরর গোপনীয়তা রক্ষার জন্য চীনে খুব কমই নীতিমালা রয়েছে। সেইসাথে রয়েছে প্রচুর তথ্য। যেমন-দেশটির সর্বত্র সিসিটিভি ফেসিয়াল রিকগনিশন লাগানো রয়েছে। কল্পনা করুন এআই সৃষ্ট ছবিগুলোর জন্য এটি কতটুকো কার্যকর হবে।
এআই সুপারপাওয়ারস
চায়না সিলিকন ভ্যালি এবং নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের লেখক লি কাই ফু বলেছেন, চীনের প্রযুক্তি সম্প্রদায়কে আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় পিছিয়ে থাকতে দেখলেও এর ডেভেলপাররা ভালো অবস্থানে রয়েছেন। তারা এমন একটি বিশ্বে বাস করে যেখানে গতি অপরিহার্য, নকল করা একটি স্বীকৃত চর্চা এবং নতুন বাজার ধরতে প্রতিযোগিদের কোন কিছুই থামিয়ে রাখতে পারে না।
এই রু² ওএআই সুপারপাওয়ারস:চায়না সিলিকন ভ্যালি এবং নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের লেখক লি কাই ফু বলেছেন, চীনের প্রযুক্তি সম্প্রদায়কে আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় পিছিয়ে থাকতে দেখলেও এর ডেভেলপাররা ভালো অবস্থানে রয়েছেন। তারা এমন একটি বিশ্বে বাস করে যেখানে গতি অপরিহার্য, নকল করা একটি স্বীকৃত চর্চা এবং নতুন বাজার ধরতে প্রতিযোগিদের কোন কিছুই থামিয়ে রাখতে পারে না।
কঠিন পরিবেশ সিলিকন ভ্যালির সাথে একটি বৈপরীত্য তৈরি করেছে। সিলিকন ভ্যালিতে নকল করা কলঙ্কজনক এবং কোম্পানিগুলোকে এখানে নতুন আইডিয়া নিয়ে আসতে হয়।’ চীনের কপিক্যাট যুগের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে, বিশেষ করে মেধাসম্পদকে ঘিরে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এরমধ্য দিয়ে একটি চতুর ও কঠিন উদ্যেক্তাদের প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আশির দশক থেকে চীনের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে; মূলত ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ওপর নির্ভর করেই দেশটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। দেশটির ম্যানুফ্যাচারিং খাতও প্রযুক্তি নির্ভর। গত দশকে চীনের ভোক্তা নির্ভর ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো অনেক উদ্ভাবনের স্বাক্ষর রেখেছে।
চীন কি পেরে উঠবে?
চীনের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর চমৎকার কিছু সুবিধা থাকলেও বেইজিংয়ের কর্তৃত্ববাদী কর্মকান্ডের পুরো প্রভাব কতদূর গড়াবে তা এখনো পরিস্কার নয়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে সেন্সরশীপের কারণে চীনের এআই চ্যাটবট উদ্ভাবন কাজ কতটুকো প্রভাবিত হবে। এই চ্যাটবট কি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে নিয়ে সংবেদনশীল কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? ’ ইয়াং এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ‘আমি মনি করি না যে চীনে বাইদু অথবা এরনিতে কেউ বিতর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে। কারণ তারা যানে এসব প্লাটফর্ম সেন্সর করা।’ সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বিশেষ বিশেষ প্রযুক্তিতে চীনের প্রবেশ আটকে দিতে যুক্তরাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা এআই ইন্ডস্ট্রিকেও প্রভাবিত করতে পারে। উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার চিপস অথবা সেমিকন্ডাক্টর এখন ওয়াশিংটন এবং বেইজিংয়ের মধ্যে প্রধান উত্তেজনার বিষয়। এই যন্ত্রাংশগুলো ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনের মতো আমাদেও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পণ্য তৈরিতে খুবই প্রয়োজনীয়। এমনকি বিভিন্ন সামরিক অ্যাপ্লিকেশনের জন্যও তা দরকারি। এছাড়া এআই লার্ণিয়ের জন্যও এসব প্রযুক্তি লাগে।
এনভিডিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি কোম্পানি সম্প্রতি এআই চিপ উৎপাদনে কাজ করছে। রফতানি নিষেধাজ্ঞার কারণে চীনের খুব অল্পসংখ্যক কোম্পানি চ্যাটিজিপিটির সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই রফতানি নিষেধাজ্ঞা মোবাইল ল্যাপটপের মতো ভোক্তাপণ্য উৎপাদনে কোন প্রভাব ফেলবে না। কারণ রফতানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে করে সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য এআই প্রযুক্তি উদ্ভাবন না করা হয়।’ এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে চীনকে নিজস্ব সিলিকন ভ্যালি গড়ে তুলতে হবে। সেখানে বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে দক্ষ কর্মীদের আকৃষ্ট করার মতো গবেষণা সংস্কৃতি থাকবে। অন্যদিকে বেইজিং তাদের ‘বিগ ফান্ডের’ মাধ্যমে এতোদিনের ব্যবধান ঘোচানোর চেষ্টা করছে। চিপ কোম্পানিগুলোকে বিপুল পরিমান প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপশি প্রযুক্তি খাতের ওপর সরকারের কড়া নজরদারি রয়ছে। মার্চ মাসেও দূর্ণীতির অভিযোগে টেকনলজি টাইকুন ঝাও ওয়েগাওকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
ধারণা করা হচ্ছে কিছু নির্দিষ্ট শিল্পের ক্ষেত্রে বেইজিং আর্থিক প্রণোদনা দিতে পারে এবং নীতিমালা শিথিল করতে পারে। তবে এর অর্থ আরো নজরদারি, শঙ্কা এবং অনিশ্চয়তা। ঝাও এর গ্রেফতার অন্যান্য রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানিগুলোকে এই বার্তা দিচ্ছে যে রাষ্ট্রের অর্থ নিয়ে কোন নয়-ছয় করা যাবে না বিশেষ করে চিপের ক্ষেত্রে। চীনের ভবিষ্যত এআই শিল্পের ওপর এই বার্তা কতটুকো প্রভাব ফেলে এখন সেটিই দেখার বিষয়।
বিবিসি/আরএপি
from টেক শহর https://ift.tt/c5W0yPe