৫ কোটির বেশি সিমের মালিকানা-তথ্যে গরমিল

আল-আমীন দেওয়ান : মোবাইল ফোন অপারেটরদের ৫ কোটির বেশি গ্রাহকের সিমের মালিকানা কিংবা বিভিন্ন তথ্যে গরমিল ঘটেছে।

অপারেটরদের সার্ভারে থাকা গ্রাহকদের সিমের তথ্যের সঙ্গে বিটিআরসির সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্লাটফর্ম (সিবিভিএমপি) তথ্যের সঙ্গে মূলত এই বৈসাদৃশ্য বা গরমিল।

বিটিআরসি জানায়, ইতোমধ্যে সিমের মালিকানা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্যের বিশুদ্ধতা নিশ্চিতে সিবিভিএমপির ডেটার সঙ্গে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের নিজ নিজ সার্ভারের ডেটার ডেল্টা রি-কন্সিলিয়েশন করার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে।

Techshohor Youtube

তবে এই রি-কন্সিলিয়েশন পরবর্তী পরিবর্তিত তথ্যের বিষয়ে কোনো ধরনের জটিলতার জন্য যদি আইনি জটিলতা তৈরি হয় তার দায়ভার মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর উপর থাকছে।

গরমিল যেভাবে :

বিটিআরসি ও মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো বলছে, অপারেটর সিস্টেম হতে সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্লাটফর্ম (সিবিভিএমপি) সল্যুশনে ডেটা মাইগ্রেশনের পর ডেটা রি-কন্সিলিয়েশন বা সমন্বয় না হওয়ায় সিম সংক্রন্ত তথ্যের এই অমিল দেখা যায়।

২০১৭ সালের ১৫ জুন মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর গ্রাহকদের নিবন্ধন তথ্য সিবিভিএমপিতে স্থানান্তর করা হয়। এর একদিন পরই সিস্টেমটি পুরোপুরি চালু করা হয়। সিবিভিএমপি চালুর পর বিটিআরসি সিম সংক্রান্ত এই তথ্যের গরমিল দূর করতে ৩ বছর ধরে কাজ করছে। এরমধ্যে দু’বছর আগে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের গ্রাহকের তথ্য রি-কন্সিলিয়েশনের সিদ্ধান্ত হয়। তখন এর জন্য স্টান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) তৈরি করা হয়। সে অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ মে পর্যন্ত তিন অপারেটরের প্রাথমিক ডেটা রি-কন্সিলিয়েশন করা হয়।

এরপর অপারেটরগুলো বিটিআরসির কাছে ডেল্টা ডেটা রি-কন্সিলিয়েশনের জন্য বিটিআরসির কাছে আবেদন করে। সেখানে ২০২০ সালের ১ জুন হতে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ডেটা রি-কন্সিলিয়েশন করার কথা বলা হয়।

অপারেটরগুলো এই সময়ের গ্রাহক ডেটার ডেল্টা রি-কন্সিলিয়েশন সংক্রান্ত তথ্য জমা দেয়। এরপর সিবিভিএমপিতে থাকা অপারেটর তিনটির গ্রাহকের সিমের মালিকানার তথ্যের সঙ্গে তাদের দেয়া তথ্যের এই বিপুল বৈসাদৃশ্য বা গরমিল দেখা যায়।

কোন অপারেটরের কতো সিম ও গরমিলের ধরন ?

তিন অপারেটরের মোট ৫ কোটি ২৬ লাখ ৪৭ হাজার ২৬৩ টি সিমের তথ্যের গরমিল দেখা যায়। এতে ১০ ধরনের তথ্যের বৈসাদৃশ্য আসে।

এরমধ্যে গ্রামীণফোনের ৪৮ লাখ ১৬ হাজার ৭২১ টি সিমে , বাংলালিংকের ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬০ টি সিমে এবং রবির (এয়ারটেল ০১৬ ) ৪৮ লাখ ৯৪ হাজার ১৫৯ টি সিমে ও (রবি০১৮) ১ কোটি ৬০ লাখ ৯০ হাজার ৬২৩ টি সিমে এই গরমিল।

তিন অপারেটরের সিমের গরমিলের ধরন ও সংখ্যা

কী ব্যাখ্যা বিটিআরসির ?

সিবিভিএমপিসহ আপারেটরদের সিম নিবন্ধনের এই বিষয়টি সরাসরি দেখভাল করে বিটিআরসির সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগ।

এই বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ টেকশহর ডটকমকে জানান, ‘সিম কেনার সময় যখন আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয় তখন ছাপটাকে চেক করা হয় নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেইজের সঙ্গে। যদি ম্যাচ করে, গ্রিন সিগন্যাল পেলে তার নামে একটা সিম ইস্যু হয়। যখন সিম ইস্যু হয় তখন মোবাইল অপারেটরের কাছে গ্রাহকের নাম, গ্রাহকের এনআইডি, সিম নাম্বার ইস্যু হয়। এ তথ্যটাই সিবিভিএমপিতে জমা হয়। আগে যেটা হতো, ২০২১ সালের এর আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সিবিভিএমপির ডেটাবেইজের সরাসরি কোনো কানেক্টিভিটি ছিলো না। সেটাই আমরা ২০২২ সালের জানুয়ারিতে করে ফেলেছি। এখন এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে।’

‘এখন কেউ সিম নিতে গেলো, আঙ্গুলের ছাপটা মোবাইল অপারেটরের ডিভাইস হতে রিকোয়েস্ট পাঠালো, রিকোয়েস্টে যে রেজাল্ট আসবে ওই রেজাল্টটা আগে আমাদের সিবিভিএমপি ডেটাবেইজে আসবে তারপর মোবাইল অপারেটরদের কাছে যাবে। এরফলে ডেটা মিসম্যাচ হওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকবে না’ বলছিলেন তিনি।

এগুলো কী ধরনের মিসম্যাচ তা ব্যাখ্যা করছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ । টেকশহর ডটকমকে বলছিলেন, ‘ডেটা মিসম্যাচ মানে বড় কোনো কিছু নয়। প্রতিটি সিমের একটা আইএমএসআই নম্বর থাকে, যখন কেউ সিম চেইঞ্জ করে তখন আগের আইএমএসআই নাম্বার চেইঞ্জ হয় না, আগেরটাই থাকে। পরে যখন আমরা কম্পেয়ার করতে যাই তখন দুটি সিমের এই আইএমএসআই নাম্বারে মিসম্যাচ আসে। এটা কোনো বড় পার্থক্য নয়, এতে আইনগত কোনো সমস্যা হয় না।’

‘আগে একেক মোবাইল অপারেটর একেকভাবে করে তাদের তথ্য পাঠিয়েছে। তথ্য মানে, মূল নামে সমস্যা নেই। যেটা হয়, এনআইডির জায়গায় হয়তো ড্রাইভিং লাইসেন্স চলে আসে। কেউ রেজিস্ট্রেশনের পর গিয়ে ডেট অব বার্থ চেইঞ্জ করলো-এটা জানা যাবে কীভাবে ? এটা মোবাইল অপারেটরও জানে না, আমরাও জানি না। এমন তথ্য এদিক-সেদিক হলে কোনো সমস্যা নেই। এ ধরনের কিছু কিছু জিনিস, তথ্যগত কিছু ভুল। তবে এ তথ্যগত ভুলের সাথে রিয়েল লাইফের কোনো সমস্যা নেই।’

‘এটা ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক করার এই সাহসিক কাজটাই নিয়েছি। আগে ৫ বছরে এটা কেউ করেনি। ঠিক না করে নতুন করে সমস্যা হোক এটা চাই না। তথ্যগুলো যেনো অ্যাকুরেট অ্যাজ পসিবল হয়। আর আগের ডেটাও আমরা রেখে দিচ্ছি।’ জানান বিটিআরসির এই মহাপরিচালক।

‘রি-কন্সিলিয়েশন কন্টিনিউয়াস প্রসেস। আমরা ২০২০ সালের মে পর্যন্ত রি-কন্সিলিয়েশন কমপ্লিট করেছি। এখন আমরা ডেল্টা-ওয়ান, মানে ওটার পরেরটা করছি। যা ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। মানে ২০২২ পর্যন্ত ঠিক হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরেকবার করবো।’ বলছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম।

কী বলছে মোবাইল অপারেটররা ?

গ্রামীণফোনের মুখপাত্র হোসেন সাদাত টেকশহর ডটকমকে বলেন, ‘সিবিভিএমপি সিস্টেম এবং অপারেটরের নিজস্ব সিস্টেম – দুইটি স্বতন্ত্র আইটি প্ল্যাটফর্ম। এই দুই প্লাটফর্মের মধ্যে সঠিক সমন্বয়ের জন্য নিয়মিত রি-কন্সিলিয়েশন প্রয়োজন। বিটিআরসির সাথে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিগত ২০১৯ সাল থেকে আমরা এইরকম রি-কন্সিলিয়েশন করে আসছি এবং যা বর্তমানেও চলমান।’

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম টেকশহর ডটকমকে বলেন, ‘বিটিআরসির সিবিভিএমপির রি-কন্সিলিয়েশনের সাথে আমাদের তথ্যের কোনো গরমিল নেই। তবে কিছু বিষয় রি-কন্সিলিয়েশন করার সময় তথ্যের শুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা বিটিআরসির সাথে কাজ করি, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। গ্রাহকের তথ্যের নিরাপত্তার বিষয়ে এখানে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না, এ ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সচেতন।’

বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট এন্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান টেকশহর ডটকমকে বলেন, ‘বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়াটি ২০১৫ সালে শুরু হয় এবং পরবর্তীতে সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিক্স ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্ল্যাটফর্মটি (সিবিভিএমপি) এই ইকোসিস্টেমে চালু করা হয়। বাংলালিংকসহ সকল মোবাইল অপারেটরের সাথে সিবিভিএমপির রি-কন্সিলিয়েশন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাংলালিংক নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনাগুলি সম্পূর্ণভাবে মেনে চলে এবং গ্রাহকদের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনকে কার্যকর ও নিখুঁত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া, ব্যবস্থা ও সেগুলির চলমান উন্নয়নকে সবসময় সমর্থন করে। আমরা গ্রাহকদের রেজিস্ট্রেশন সহজ ও সুবিধাজনক করার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছি।’

সাড়া নেই টেলিটকের :

তথ্যের গরমিল ও তা সমাধানে টেলিটকের কোনো সাড়া পায়নি বিটিআরসি। অপারেটরটি এখন পর্যন্ত কোনো ডেটা দেয়নি এবং তাদের গ্রাহকের তথ্যের রি-কন্সিলিয়েশন হয়নি। ফলে অপারেটরটির কত সংখ্যক গ্রাহকের সিমের তথ্যে গরমিল রয়েছে বা আছে কিনা, তা জানা জায়নি।

বিটিআরসি অবশ্য টেলিটকের কাছে এর কারণ জানতে চেয়েছে।

গরমিল ঠিক করতে যা করা হচ্ছে :

বিষয়টি সমাধানে ডেল্টা ডেটা রি-কন্সিলিয়েশনসহ বিটিআরসির আরও সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে তথ্য সংশোধনের পর রি-কন্সিলিয়েশনের আগের ডেটাও সিবিভিএমপিসহ অপারেটর তিনটি প্রত্যেকেই সংরক্ষণ করবে। যেন রি-কন্সিলিয়েশনের পর তথ্যে সমস্যা হলে এই ডেটাও বিশ্লেষণ করা যায়।

সিবিভিএমপির ডেটার সঙ্গে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের নিজ নিজ সার্ভারের ডেটার প্রতিবারের ডেল্টা রি-কন্সিলিয়েশনের পর রি-কন্সিলিয়েশন প্রতিবেদন বিটিআরসিতে জমা দিতে হবে।

বিটিআরসির ভাইস-চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন আহমেদ টেকশহর ডটকমকে বলেন, সিবিভিএমপি বিটিআরসির খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। উদ্যোগটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে। আমরা এর মাধ্যমে এই বিষয়গুলোকে একটি অর্গানাইজড জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। শুরুর দিকে যখন বিষয়গুলো সিস্টেমেটিক ছিলো না তখন তো কিছু সমস্যা ছিলোই-সেগুলোই আমরা এই রি-কন্সিলিয়েশন বলেন বা অন্যান্য পদক্ষেপ, চেষ্টা করছি ভবিষ্যতে যেনো না হয়। এখন কোনো মিসম্যাচ হলেও আমাদের কাছে ধরা পড়বে, গরমিল যেগুলো আছে সেগুলো এই টেকনিক্যাল রি-কন্সিলিয়েশনের পর ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টেকশহর ডটকমকে বলেন, টেলিকম ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে ধরনের সচেতনতা, দক্ষতা, দেশপ্রেম কাজ করা দরকার সেই জায়গাগুলোর প্রায় জায়গাতেই আমরা ঘাটতি দেখি। আমরা অডিট করতে গিয়ে শতশত কোটি টাকার গরমিল পাই। আমরা এখনও বেআইনিভাবে সিম বিক্রির খবর পাই। এটা যে অপারেটররা করছে তা নয়, অপারেটরদের ডিলাররা করছে। ব্যবস্থাটা কে নেবে ?

মন্ত্রী বলেন, সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্লাটফর্মের (সিবিভিএমপি) মাধ্যমে এখন এ সংক্রান্ত যেকোনো অনিয়ম ধরা সম্ভব। বিটিআরসি তথ্যসংক্রান্ত বিষয়গুলো যাই আছে নির্ভুল করে নিচ্ছে। আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে, একেবারে শতভাগ নির্ভুল প্রযুক্তি আমরা এখন দিতে পারছি। এখন আমরা যদি সিম, হ্যান্ডসেট ও টেলিযোগাযোগের যে ক্ষেত্র সেখানে মনিটরিংয়ের ক্ষমতা না রাখি অপরাধের দুনিয়ায় টিকে থাকা যাবে না।



from টেক শহর https://ift.tt/jYdX8Ra
Previous Post Next Post