কোন প্রতিষ্ঠান যখন সফলতার শিখরে উঠে তখন এর কর্ণধার প্রশংসায় ভেসে যান। আবার এর বিপরীত পরিস্থিতি অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ বা সমালোচিত হলেও এর দায়ভার গ্রহন করতে হয় তাকে। বর্তমানে এমন সময় অতিক্রম করছেন একদিকে তুমুল জনপ্রিয় ও চরম সমালোচিত সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম টিকটকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও শাও জি চিউ।
টিকটক অ্যাপ ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য চীনা সরকারের কাছে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনেক দেশই তাদের সরকারি কর্মীদেরকে অফিসের ফোনে টিকটক অ্যাপ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যদিও চীনা কোম্পানি বাইটডান্সের মালিকানাধিন কোম্পানিটি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে।
কোম্পানির বিরুদ্ধে তথ্য পাচারের অভিযোগের গত বৃহস্পতিবার প্রেক্ষিতে মার্কিন কংগ্রেসে আইন প্রনেতাদের কঠিন জেরার মুখে পড়েন টিকটক সিইও শাও জি চিউকে। ৪০ বছর বয়সী এই সিঙ্গাপুরের নাগরিককে টানা পাঁচ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মূলত টিকটকের চীনের সাথে কতটুকো ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এবং টিকটক ব্যবহারকারী শিশু কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
টিকটক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে সিইও চিউকে নিয়েও কথাবার্তা চলছে। তবে তিনি কিভাবে কোম্পানিটি পরিচালনা করছেন বা টিকটকে তার ক্ষমতা কতটুকো এ বিষয়ে খুব বেশি তথ্য নেই। সে তুলনায় কোম্পানিটির চিফ অপারেটিং অফিসার ভানেসা পাপ্পাস বেশ পরিচিত। যদিও মার্কিন নাগরিকদের তথ্য চীনে পাচার নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে তাকেও জেরার মুখে পড়তে হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে নিউিইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে টিকটক ও বাইটডান্সের সাবেক নির্বাহি কর্মকর্তাদের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়, চিউয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা সীমিত। মূলত বাইটডান্সের প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়েমিং কোম্পানির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে টিকটক বৈরি এ সময়ে সিইও চিউকে সামনে রেখেছে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য।
জুনে মার্কিন আইনপ্রনেতাদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, টিকটক স্বায়িত্ত্বশাসিতভাবে পরিচালিত হয়। এছাড়া সিইও চীনা নাগরিক নয়, সিঙ্গাপুরের।
চিউয়ের জন্ম ও বেড়ে উঠা সিঙ্গাপুরে। চীনা ঐতিহ্যবহনকারী একটি অভিজাত স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেন। ইংরেজি ও মান্দারিন দুই ভাষাতেই সাবলীল চিউ। সিঙ্গাপুরের সশস্ত্রবাহিনীতে তিনি সম্মানজনক পদে কাজ করেছেন। ইউনিভার্সটি কলেজ লন্ডন ও হাভার্ড বিজনেস স্কুল থেকেও ডিগ্রি নিয়েছেন তিনি। শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করেছেন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম ফেসবুকেও।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ডিএসটিতে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সেখানে তার নের্তৃত্ব দেয়া একটি দল ২০১৩ সালে বাইটডান্সের বিনিয়োগকারি হয়ে উঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসেও তিনি দুইবছর চাকরি করেছেন। চীনের স্মার্টফোন জায়ান্ট শাওমির প্রধান আর্থকি কর্মকর্তা ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
২০২১ সালের মাের্চ বাইটডান্সের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার হিসেবে যোগ দেন চিউ। এর মাত্র চারমাস পরেই টিকটকের সিইও করা হয় তাকে।
চিউয়ের সামনে যে চ্যালেঞ্জ
টিকটকে কাজ শুরু করার পর থেকে সবচেয়ে কঠিন সময় অতিক্রম করছেন চিউ। মার্কিন আইনপ্রনেতারা কোম্পানিটিকে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সম্পদের মালিকানা ভাগ অথবা নিষেধাজ্ঞা বরণ করে নেয়ার মতো শর্ত দিয়েছে। বিষয়টি চীনের জন্য্যও একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের এক লেখায় বলা হয়েছে টিকটককে নিষেধাজ্ঞার দিকে ঠেলে দেয়া ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিষাক্ত রাজনৈতিক পরিবেশের’একটি শিকার। এটি হবে মুক্তবাজার নীতিমালা লঙ্ঘন। আমেরিকার সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের কাছে টিকটকের চীনা পটভূমিই ‘আসল পাপ।’
উভয়দিকের কঠোর নজরদারির মুখে চিউ সম্প্রতি বিব্রতকর সময় অতিক্রম করছেন। এতোদিন আড়ালে থাকলেও কোম্পানি রক্ষার জন্য নিজেকে প্রকাশ করছেন চিউ। নিজের ব্যক্তিগত জীবন দেখানোর জন্য গত ফেব্রুয়রিতে টিকটক অ্যাকাউন্ট খূলেছেন। প্লাটফর্মটির দায়িত্ব নেয়ার প্রায় এক বছর পর তিনি এ অ্যকাউন্ট ওপেন করলেন। তবে তিনি বলেছেন তার সন্তানরা বেশি ছোট হওয়ার কারণে টিকটক ব্যবহার করতে দেন না।
টিকটক যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরে বিপরীতে কাজ করছেন না এমন নিশ্চয়তা দিতে সম্প্রতি তিনি কয়েক রাউন্ড মিডিয়া আউটলেট প্রকাশ করেছেন। এছাড়া টিকটক ব্যবহারকারী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছেও সরাসরি সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। টিকটকের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্টে তিনি গত সোমবার ওয়াশিংটন থেকে এক ভিডিও আউটলেটে বলেছেন, ‘এটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন মুহুর্ত। আপনাদের থেকে টিকটক বহুদূরে চলে যেতে পারে।’
বিবিসি/আরএপি