‘মা’ হওয়ার পর মস্তিষ্কে পরিবর্তন কেন হয়?

টেকশহর কনটেন্ট কাউন্সিলর : সারা ব্লুমেনস্টাইন সদ্যেজাত মেয়েকে নিয়ে টিকা দিতে গিয়েছেন। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে বললেন বাচ্চাকে ভুলিয়ে রাখতে একটি গান গাইতে। কিন্তু ব্লুমেনস্টাইন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন শিশুদের কোন গান তার মনে আসছে না। নিজের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এমন ছিলো তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন আপনি কি বর্ণমালা জানেন?’ আমি উত্তর দিলাম ‘আমি বর্ণমালা জানি। তবে এটি মনে করতে আমার একটু সংকেত লাগবে, একটু সাহায্য প্রয়োজন।’

ব্লুমেনস্টাইনের মতো এমন অনেকেই রয়েছেন মা হওয়ার পর যারা মারাত্মক ভুলোমনা হয়ে যান। অনেক সময় দেখা যায় হাতের মধ্যে কোন জিনিস নিয়ে সারা বাসা তন্নতন্ন করে তা খোঁজে বেড়াচ্ছেন। চুলায় রান্না বসিয়ে বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। পোড়া গন্ধ নাকে আসার পর মনে হলো আরে! আমি তো রান্না বসিয়েছিলাম। নতুন মায়েদের এমন অবস্থাকে ‘মাম্মি ব্রেইন’ নামে অভিহিত করা হয়। এটি মূলত গর্ভকালীন সময়ের এক ধরনের প্রভাব; যার মধ্য দিয়ে অনেক মা’কেই যেতে হয়।

সন্তান হওয়ার পর মায়েদের ভুলে যাওয়ার সমস্যাকে ‘প্রেগন্যান্সি ব্রেইন’ এবং ‘মোমেনসিয়া’ও বলা হয়ে থাকে। সাধারনত কারো সাথে অ্যাপয়নমেন্ট দিলে তা ভুলে যাওয়া, দিন-তারিখ মনে না থাকা এবং সন্তান ব্যতিত অন্য যে কোন কিছুর প্রতি মনযোগ সরে যাওয়া বোঝাতে এ দুটি টার্ম ব্যবহার করা হয়। গর্ভকালীন সময়ে ৮০ শতাংশ মা’ই ভুলে যাওয়ার সমস্যার কথা জানিয়েছেন। এ অবস্থায় বিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘মাম্মি ব্রেইন’ এই ধারণাটি পুনরায় পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

Techshohor Youtube

নিউরোসায়েন্টিস্ট ক্লেয়ার ম্যাককরম্যাক বলেছেন,‘ আপনি যখন স্মৃতির বিষয়টির দিকে উল্লেখযোগ্যভাবে নজর দিবেন তখন বিষয়টি দেখতে পাবেন। মা হয়েছেন এবং মা হন নি এমন তাদের মধ্যে পর্যবেক্ষণগত পার্থক্য কতোটা তা বোঝা যায়।’ সহযোগি অধ্যাপক ব্রিজেট ক্যালাগান এবং নিউরোসায়েন্টিস্ট জোডি পাওলুস্কির সাথে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন ম্যাককরম্যাক। এই গবেষণায় ‘মাম্মি ব্রেইন’ এই টার্মটিকে পুন:ব্রান্ডিং করার আহবান জানানো হয়েছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে জেএএমএ নিওরোলজিতে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। গবেষণায় বলা হয়, ‘এই মানসিক অবস্থাকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। মায়েদের মস্তিষ্কের এই অনিবার্য আখ্যান এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করতেও অবদান রাখছে।’ ম্যাককরম্যাক আরো বলেন, মার্তৃত্বের সাথে সাথে যা হারিয়েছি তার দিকে মনযোগ কম দিয়ে যা পেয়েছি এবং যা পেতে যাচ্ছি সে দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, এমন হতে পারে আপনি ততটা ভুলে যাচ্ছেন না কিন্তু যতটুকো ভুলে যাচ্ছেন সে বিষয়ে বেশি সচেতন হয়ে উঠার কারণে একটি লেবেলের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে আপনি যদি ‘মাম্মি ব্রেইন’ এই টার্মটির সাথে পরিচিত হয়ে থাকেন তাহলে পিতা-মাতা হওয়ার সাথে সাথেই নিচের পরিচয় অথবা সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবেন আপনি। এটি আপনার জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।’

ম্যাককোরম্যাক বলেছেন ‘বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যে গুরুত্বপূর্ণ ফাঁকফোকর রয়েছে সে বিষয়ে মনোযোগ আকৃষ্ট করতেই’ টার্মটি রিব্রান্ডিং করতে হবে। মার্তৃত্বের সময় যা হারিয়ে গিয়েছে সে দিকে মনযোগ কমিয়ে কি অর্জিত হয়েছে আর কি অর্জিত হবে সে বিষয়ে মনযোগ দিতে হবে। আর এই ধারণাগত পরিবতন সত্যিকার অর্থেই অনেক শক্তিশালী বিষয়। যখন ফোকাস পরিবর্তন করা হবে এবং গর্ভকালীন চিন্তাভাবনা ও অভিভাবকত্বের মধ্যে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার দিকে মনোযোগ দেয়া যাবে। যা সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর।’

তিনি আরো বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে মস্তিষ্কে পরিবর্তনের সাথে আপনি যখন গর্ভকালীন সময়ের পরিবর্তন তুলনা করলে দেখবেন দুটি প্রায় একই রকম। আমি মনে করি এটি চিন্তা করার এটি শক্তিশালী উপায়। গর্ভকালীন সময়ে ও এর পরবর্তী সময়ে মায়েদের মস্তিষ্কের কাঠামো কিভাবে পরিবর্তিত হয় তা রীতিমতো বিস্ময়কর বিষয়। ম্যাককরমেক বলেছেন, ‘সর্বোপরি মস্তিষ্কের আয়তন হ্রাস পায় এবং মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশে ধূসর রংয়ের পরিমান কমতে থাকে।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর এডিকসন অ্যান্ড মেন্টাল হেলথের ট্রিলিভিং ফ্যামেলি চেয়ার নিউরোসায়েন্টিস্ট লিসা গালেয়া বলেছেন, প্রসবোত্তর পর্যায়ে মস্তিষ্কে ধূসর পদার্থের পরিমান হ্রাস পেতে থাকে। অথচ একজন ব্যক্তির বয়সের সাথে সাথে ধূসর টিস্যুর পরিমান বাড়তে থাকে।’ গর্ভকালীন ও এর পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের এই পরিবর্তনগুলো মূলত ‘হরমোনের ব্যাপক পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত।’

কেউ কেউ একে মহাশক্তি হিসেবেও বর্ণনা করেছেন বলে জানিয়েছেন গ্যালোওয়ে। কারণ আপনার আগে কোন শিশু ছিলো না, আপনি আগে কখনো তার সাথে থাকেন নি। একটি জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আপনার। অনেকেই গর্ভাবস্থাকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সময়কাল হিসেবে বর্ণনা করতে ‘ম্যাট্রেসেন্স’ শব্দটি ব্যবহার করে। গর্ভকালীন সময়ের হরমোন পরিবর্তনের সাথে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে হরমোন পরিবর্তনের মধ্যে সমান্তরাল সম্পর্ক দেখতে পান ম্যাককোরম্যাক। কারণ দুটি পরিবর্তনের সময়ই মানুষ নতুন নতুন দক্ষতা, বহুমুখি কাজ এমনকি পরবর্তী জীবনের জন্য ভালো স্মৃতি ধারণ করে।

নিওরোসায়েন্টিস্ট লিসা গালিয়ার ল্যাব সম্প্রতি ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন হাজার নিওরোসায়েন্স ও সাইক্রিয়াট্রির ওপর তিন হাজারের বেশি গবেষণা পর্যালোচনা করেছেন। গবেষনায় দেখা গিয়েছে নারী ও নারী প্রাণীদের তুলনায় পুুরুষ ও পুরুষ প্রাণীদের নিয়ে নয়গুন বেশি গবেষণা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের নিয়ে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে তাদের ‘নারীরা হরমোনজনিত হওয়ার কারণে তাদেরকে ব্যবহারের প্রয়োজন নেই; তারা খুব জটিল। তাই শুধু পুরুষদেরই ব্যবহার করি। অথচ নারী-পুরুষ পুরোপুরি আলাদা।

তিনি আরো বলেছেন, নারী ও স্ত্রী প্রাণীদের মধ্যে কি ঘটছে তা গবেষণা করে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঋতু¯্রাব, হরমোনজনিত গর্ভনিরোধক ব্যবহার এবং গর্ভকালীনের মতো অন্যন্য অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। হরমোন সম্পর্কে প্রায়াই যেসব ভাষা ব্যবহার করা হয় তা প্রায়ই মেনে নেয়া হয় না কিন্তু তা মেনে নেয়া উচিত।’

সিবিসি/আরএপি



from টেক শহর https://ift.tt/uYRgjpT
Previous Post Next Post