আল-আমীন দেওয়ান : স্পেকট্রাম সংশ্লিষ্ট পুরো ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হয়েছে বিটিআরসি।
শুধু তাই নয় স্পেকট্রাম নিয়ে ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে এখনই হাঁটা শুরু করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি। ভবিষ্যতের স্পেকট্রামের বিপুল চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ কীভাবে আসবে তার ‘কৌশল’ ইতোমধ্যে হাতে নিয়েছে তারা।
অন্যদিকে মানসম্মত টেলিযোগাযোগ সেবা, স্পেকট্রামের সর্বোচ্চ ব্যবহার, দাম ও শর্ত, নিলাম-রাজস্ব আয় ইত্যাদি নিয়ে যুগোপযোগী স্পেকট্রাম রোডম্যাপও তৈরি করছে বিটিআরসি।
ইতোমধ্যে নতুন স্পেকট্রামের ব্যান্ড নির্ধারণে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রোডম্যাপ তৈরিতেও করা হয়েছে কমিটি।
দেশে কোথায় কতো স্পেকট্রাম ?
রেডিও রেগুলেশন অনুযায়ী বাংলাদেশে ব্যবহারযোগ্য স্পেকট্রাম ৮১৫ মেগাহার্জ। যেখানে ইতোমধ্যে ৩৮১ দশমিক ৬ মেগাহার্জ মোবাইল ফোন অপারেটরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান,বাহিনী ও সংস্থা বরাদ্দ নিয়েছে। বাকি আছে ৪৩৩ দশমিক ৮ মেগাহার্জ।
এরমধ্যে পর্যন্ত মোবাইল ফোন অপারেটররা বরাদ্দ নিয়েছে ৩৭৬ দশমিক ৬ মেগাহার্জ। এই স্পেকট্রাম নবায়ন করার সঙ্গে ভবিষ্যতে বাকি ৪৩৩ দশমিক ৮ মেগাহার্জ তরঙ্গও পাবে অপারেটররা।
ইতোমধ্যে ২০২২ সালে গ্রামীণফোন ও রবি ২৬০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে যথাক্রমে ২০ মেগাহার্জ করে ৪০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম চেয়ে আবেদন করেছে। বাংলালিংকও সামনে ২৩০০ ব্যান্ডে ২০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম চেয়ে আবেদন করে রেখেছে।
সংকট কোথায় ?
জিএসএমের পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে সব মোবাইল ফোন অপারেটর মিলে ২ হাজার মেগাহার্জ স্পেকট্রাম দরকার হবে। জিএসএমের পর্যবেক্ষণকে ধরলে বাংলাদেশে আগামী ৭ বছরের মধ্যে আরও ১১৮৫ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম দরকার হবে।
বিটিআরসি বলছে, দেশের গ্রামাঞ্চলসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৭০০ এবং ৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ড স্পেকট্রাম উপযোগী বেশি। এই দুই ব্যান্ডে বরাদ্দযোগ্য স্পেকট্রাম আছে ৬৩ দশমিক ৪ মেগাহার্জ। যেখানে ৭০০ ব্যান্ডে থাকা ৪৫ মেগাহার্জের পুরোটাই এখনও বরাদ্দযোগ্য রয়েছে আর ৮০০ ব্যান্ডে ২০ মেগাহার্জের মধ্যে ১ দশমিক ৬ মেগাহার্জ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ২০২৪ সালের শুরুতে এই স্পেকট্রাম বরাদ্দ দিয়ে দিতে চায়। অন্যদিকে ২০২৬-২০২৭ সাল নাগাদ দেশে বাণিজ্যিকভাবে ৫জি চালু হয়ে গেলে ৩৫০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে ৩০০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম বরাদ্দ দিতে হবে। ৩৫০০ ব্যান্ডে বাংলাদেশের কাছে ব্যবহারযোগ্য স্পেকট্রামই রয়েছে ৩০০ মেগাহার্জ।
তাহলে ২০২৭ সালের পর বিটিআরসির কাছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বরাদ্দ দেয়ার জন্য নতুন কোনো ব্যান্ডে-স্পেকট্রাম থাকছে না।
স্পেকট্রামের খোঁজ ও বিটিআরসির পরিকল্পনা :
আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) আয়োজিত ওয়ার্ল্ড রেডিওকমিউনিকেশন কনফারেন্স বা ডব্লিউআরসি স্পেকট্রাম ব্যান্ড নির্ধারণের সর্বোচ্চ ফোরাম। এই ফোরাম ৪ বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়। এবার ২০২৩ সালের কনফারেন্সে রিজিওন-৩ বা এশিয়া-প্যাসিফিক ও অস্ট্রেলিয়ার জন্য ৭০২৫-৭১২৫ মেগাহার্জ ব্যান্ডে মাত্র ১০০ মেগাহার্জ স্পেকট্রাম এবং রিজিওন-১ বা ইউরোপ-আফ্রিকা মহাদেশের জন্য ৬৪২৫-৭০২৫ ব্যান্ডে ৬০০ মেগাহার্জ স্পেকট্রামের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এরপর এ বছরের মার্চ-এপ্রিলে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় হয়ে যাওয়া ডব্লিউআরসির প্রস্তুতিমূলক সভায় কয়েকটি দেশ ৬৪২৫-৭০২৫ ব্যান্ড স্পেকট্রাম রিজিওন-৩ এ বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়। যা ডব্লিউআরসির এজেন্ডায় প্রস্তাব হিসেবে রয়েছে।
বিটিআরসি এই প্রস্তাব অনুয়ায়ী ৬৪২৫-৭০২৫ ব্যান্ডটি বাংলাদেশের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের জন্য ব্যবহার করতে চায়। বিটিআরসি এজন্য রেডিও রেগুলেশনের ফুট নোটে বাংলাদেশের নাম লেখাতে ডব্লিউআরসির এপিটি সভা এবং চুড়ান্ত সভায় স্বপক্ষে যুক্তিতর্কসহ লিখিত ও মৌখিক প্রস্তাব রাখতে চায়। এছাড়া এই তরঙ্গ আরও বেশি দেশে যেন ব্যবহার করতে পারে সেজন্য ২০২৭ সালের ডব্লিউআরসি সভায় এ বিষয়টি নতুন এজেন্ডা করতে চেষ্টা করবে।
আপার ৬ গিগাহার্জেই কেন ?
বিটিআরসি বলছে, এই স্পেকট্রাম ব্যান্ড মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে বরাদ্দ দিতে কারিগরি সমস্য নেই বললেই চলে। কারণ এই এটি অনেক আগে বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি) বর্তমানে বিটিসিএল কিছু মাইক্রোওয়েভ লিংকের জন্য ব্যবহার করেছে। এখন এই স্পেকট্রামে আর কোনো মাইক্রোয়েভ বা স্যাটেলাইট লিংক নেই।
এছাড়া ৬৫০০-৬৮০০ মেগাহার্জ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এ ব্রডকাস্টিংয়ে আপলিংক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই এর আর্থ স্টেশনের ৫ কিলোমিটারের বাইলে এই তরঙ্গ ব্যবহার করলে কোনো বিঘ্ন হবে না। আবার ৬৭০০-৭০০০ মেগাহার্জ কয়েকটি দেশ নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট সিস্টেমে ডাউনলিংকে ব্যবহার করে কিন্তু বাংলাংদেশে এই আর্থ স্টেশন নেই।
বিটিআরসি আরও একটি বড় কারণ এনেছে, এই স্পেকট্রামে দুই বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় করা যাবে। বছরের চার্জ, মানসম্মত মোবাইল সেবা, অপারেটরের আয় বাড়া এবং রেভিনিউ শেয়ারিং পাওয়া তো রয়েছেই।
আসছে স্পেকট্রাম রোডম্যাপ, দাম ও শর্ত বাস্তবতার নিরীখে :
স্পেকট্রাম নিয়ে একটি যুগোপযোগী রোডম্যাপ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিটিআরসি।
নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি বলছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮ বার স্পেকট্রাম বরাদ্দ ও নবায়ন করতে হবে। ১৫ বছরে স্পেকট্রামের বাৎসরিক ফি হতে আয় হতে পারে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এখন আগে যেভাবে স্পেকট্রামের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সে হিসেবে করলে স্পেকট্রাম বরাদ্দ, নবায়ন ও বছরের চার্জ মিলে ১৩ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার আয় হওয়ার কথা। কিন্তু এটি ভবিষ্যতের মোবাইল নেটওয়ার্ক খরচ এবং বছরের রাজস্বের সঙ্গে কতোটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ বা বাস্তবসম্মত তা পর্যালোচনা করতে চান তারা।
তারা এই বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছে যে, স্পেকট্রামের দাম ও অন্যান্য শর্ত যদি অসহনীয় হয় তাহলে স্পেকট্রাম ব্যবহার হবে না ও দেশে মানসম্মত মোবাইল সেবাও থাকবে না আবার রাজস্ব হতেও বঞ্চিত হবে।
বিটিআরসি ভালো মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা নিশ্চিত করতে আগের স্পেকট্রাম দাম, সামনে অপারেটরদের আয় ও স্পেকট্রামের দাম এবং প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাই করে স্পেকট্রাম রোডম্যাপ করতে ইতোমধ্যে একটি কমিটি করেছে ।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার টেকশহর ডটকমকে বলেন, ভবিষ্যতে মোবাইল অপারেটরদের মানসম্মত সেবায় স্পেকট্রামের কোনো ঘাটতি যেনো না হয় তার জন্য এখন হতেই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সামনে যে আমূল পরিবর্তন আমরা দেখতে পাবো তার সমানতালে চলতে আমাদের প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্পেকট্রামের দাম ও শর্তে বিটিআরসি ‘কঠোর’ এই অভিযোগ-অনুযোগ মোবাইল অপারেটরদের সবসময়কার। যদিও ২০২২ সালের সর্বশেষ নিলামে অপারেটরদের বেশ কিছু দাবিই বিটিআরসি মেনেছে। বিটিআরসির নতুন এই উদ্যোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও স্টেকহোল্ডার সম্পর্কের আরও উন্নয়ন হবে, এই খাতে বেশ গতি আসবে যার ভালো প্রভাব আসবে সেবার ক্ষেত্রে ।
from টেক শহর https://ift.tt/7efzVrC